স্বদেশ ডেস্ক:
আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রাজনীতিতে চলছে ত্রিমুখী বিতর্ক। ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ নিয়ে চলমান এই বিতণ্ডায় দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনও (ইসি) এখন প্রতিনিয়তই অংশ নিচ্ছে। নির্বাচন কিভাবে সুষ্ঠু হতে পারে তা নিয়ে নতুন সিইসি নিত্যনতুন মতামত দিচ্ছেন, যা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য বিতর্কের খোরাক জোগাচ্ছে।
আগামী বছরের শেষ দিকে অথবা ২০২৪ সালের শুরুতে হতে পারে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। রাজনৈতিক দলগুলো ওই নির্বাচন সামনে রেখে এখন দলীয় কর্মপরিকল্পনা গুছিয়ে নিতে শুরু করেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, দেশে চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কটের পাশাপাশি রাজনৈতিক সঙ্কটও আগামী দিনগুলোতে প্রকট হয়ে দেখা দিতে পারে।
আগামী নির্বাচন নিয়ে বেশ কয়েকটি ইস্যুতে বিএনপি তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছে। দলটি বর্তমান সাংবিধানিক ব্যবস্থায় অর্থাৎ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। জানা গেছে, বিএনপি শেষ পর্যন্ত এই দাবিতে অটল থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিএনপি এ ক্ষেত্রে বিগত দুটি জাতীয় নির্বাচনের পটভূমি সামনে তুলে ধরছে। তাদের মূল্যায়ন অনুযায়ী, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন চরমভাবে বিতর্কিত, যেখানে জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিফলিত হয়নি। এই দুটি জাতীয় নির্বাচনের প্রথমটিতে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায় না হওয়ায় বিএনপিসহ ৩০টির বেশি বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তারা আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করে মাঠে ছিল। আর ২০১৮ সালে বিএনপি জোট নির্বাচনে অংশ নিলেও ভোট আগের রাতেই সম্পন্ন করা হয়েছে বলে অভিযোগ তাদের।
বিএনপির নীতিনির্ধারকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বিগত দুটি জাতীয় নির্বাচনের ‘তিক্ত’ অভিজ্ঞতার আলোকে এবার তারা আগামী নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় এজেন্ডা ইতোমধ্যে নির্ধারণ করে ফেলেছে। এর মধ্যে মূল ইস্যু নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার অর্থাৎ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার অধীনে তারা কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। একই সাথে দলটি ‘নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার’ ইস্যু ছাড়া ভিন্ন কোনো ইস্যুতে আলোচনা কিংবা কোনো সংলাপে না বসারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে দলটি ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বিএনপি জোট নেতাদের সাথে সংলাপের প্রসঙ্গ সামনে এনেছে।
দলটির মূল্যায়ন হচ্ছে, ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনার পরেই তারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। ওই আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী তাদের সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তারা সেই প্রতিশ্রুতির সাথে বাস্তবতার কোনো মিল খুঁজে পায়নি। আলোচনার কয়েক দিন পর থেকেই নেতাকর্মীদের ধরপাকড় শুরু হয়। ১৯ জন প্রার্থীকে গ্রেফতার করা হয়। প্রার্থীরা ঘর থেকে বেরুতে পারেনি ক্যাম্পেইন করার জন্য। দলটির পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গাঁটছাড়া বেঁধে বিরোধী দলকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেয়া হয়নি। ফলে সেই নির্বাচনে গ্রহণযোগ্য কোনো ফলাফল হয়নি।
বিএনপির নীতিনির্ধারকরা বলেছেন, আগামীতে বিএনপি ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো আলোচনায় সাড়া দেবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো স্পষ্ট বক্তব্য না আসবে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের অবস্থান তুলে ধরে বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বা নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া বিএনপিসহ অনেকগুলো রাজনৈতিক দল ইতোমধ্যে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। নির্বাচন তখনই সম্ভব হবে যখন দেশে একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার থাকবে। ওই সরকারের অধীনে যে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে সেই কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করবে।
তিনি বলেন, সরকার যদি কনফ্রনটেশন (সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি) দেখতে না চায়, মারামারি কাটাকাটি দেখতে না চায় তাহলে তাদেরকে অবশ্যই আমাদের দাবিগুলো মেনে নিতে হবে, অর্থাৎ তাদেরকে পদত্যাগ করে নতুন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের জন্য যেসব ব্যবস্থা নেয়া দরকার সেসব নিতে হবে।
জানা গেছে, বিএনপি নির্বাচনকালীন সরকারের দাবিতে অনড় থাকার দলীয় অবস্থানের অংশ হিসেবেই নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে রাষ্ট্রপতি আহূত বৈঠকে অংশ নেয়নি, সার্চ কমিটির ডাকে সাড়া দেয়নি এবং নতুন ইসির ডাকে কোনো সংলাপেও যায়নি। দলটি এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনেও অংশ নিচ্ছে না। দলটি বলছে, দাবি না মানা হলে সরকার পরিবর্তনের ফয়সালা হবে রাজপথে।
অন্য দিকে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ বিএনপির ‘নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার’ দাবিকে উড়িয়ে দিয়েই সামনে এগুচ্ছে। বিএনপি এই ইস্যুতে শক্তিশালী কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে, তাও তারা মনে করছে না।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দেশে কোনো সঙ্কট নেই। নির্বাচন হবে কমিশনের অধীনে, সরকারের অধীনে নয়। সরকার শুধু রুটিন দায়িত্ব পালন করবে। নতুন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে কথা বলা হচ্ছে, সেটি একটি মীমাংসিত বিষয়। এ নিয়ে নতুন করে আলোচনার কোনো সুযোগ নেই।
আওয়ামী লীগকে আন্দোলনের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই এই দল গড়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগ ভালো করেই জানে কিভাবে আন্দোলন মোকাবেলা করতে হয়। রাজপথ কাউকে ইজারা দেয়া হয়নি। আওয়ামী লীগ রাজপথে ছিল, আছে এবং থাকবে।
তবে আগামী নির্বাচন নিয়ে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি যখন এ ধরনের বিপরীতমুখী, তখন নির্বাচন ঘিরে সামগ্রিক তৎপরতায় সতর্ক নজর রেখেছে প্রভাবশালী দেশগুলো। আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক দেখতে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। জানা গেছে, বিগত দুটি জাতীয় নির্বাচনকে এরা ‘বিতর্কিত’ বলেই মনে করে। এ কারণে আগামী নির্বাচন নিয়ে তারা তৎপর রয়েছেন। নির্বাচনের সাথে যুক্ত ‘স্টেকহোল্ডারদের’ সাথে নিয়মিত বৈঠক করছেন। আগামী নির্বাচনে পর্যাপ্ত পর্যবেক্ষক রাখারও প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ বিএনপিকে নির্বাচনে রাখতে চায়। এ কারণে সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপিকে সভা-সমাবেশের স্পেস দেয়া হচ্ছে, যেটি বছরখানেক আগেও ছিল কঠোরতায় মোড়া। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিএনপি যদি নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও করতেও আসে, তাদের বাধা দেয়া হবে না, ডেকে চা খাওয়ানো হবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের চা খাওয়ানোর বিষয়টিকে ‘পলিটিক্যাল হিউমার’ (রাজনৈতিক হাস্যরস) বললেও প্রধানমন্ত্রীর এই কথার মধ্য দিয়ে কিছুটা ‘সফটনেস’ প্রকাশ পেয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করছেন।
এ দিকে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল রয়েছেন রাজনৈতিক দলগুলোর নজরদারিতে। আগামী নির্বাচন নিয়ে তার প্রতিটি কথাই এখন আলোচনার খোরাক জোগাচ্ছে। ‘বিএনপি নির্বাচনে না এলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না’, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু হবে’, কিংবা ‘২০১৮ সালের মতো হবে না’, ‘কেউ তলোয়ার নিয়ে আসলে, না দৌড়ে রাইফেল দিয়ে মোকাবেলা’র প্রসঙ্গ বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, নিজেদের ‘গ্রহণযোগ্য’ করে তুলতে নির্বাচন কমিশন বিশেষত প্রধান নির্বাচন কমিশনার কিছু ভালো ভালো কথা বলছেন। নিজেদেরকে ‘সাহসী’ প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন তারা।
তবে ইভিএম নিয়ে যেখানে রাজনৈতিক বিতর্ক চরমে, সেখানে ইসি সেই ইভিএমের পক্ষে অবস্থান নেয়ায়, তাদের মূল উদ্দেশ্য নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছে। সম্প্রতি ‘ইভিএমে হ্যাক করা বা অনুমোদিত ব্যক্তি ব্যতীত ভোটদান এবং ভোটগ্রহণ করা সম্ভব নয়,’ এমন প্রচারণায়ও নেমেছে ইসি।
বিএনপি, বর্তমান সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ অধিকাংশ দলই ইভিএমের বিপক্ষে রয়েছে। আওয়ামী লীগসহ হাতেগোনা কয়েকটি দল ইভিএমে নির্বাচন চায়।
বিরোধীদের অভিযোগ, এই ইভিএমে ‘কারসাজি’ করেই আগামীতে আবারো ক্ষমতায় যাওয়ার পথ খুঁজছে আওয়ামী লীগ।